ব্যবসায়ীদের প্রধান সমস্যা ও উত্তরণের উপায়
সমস্যা:
অতিরিক্ত কর ও ভ্যাটের চাপ: ব্যবসায়ীরা অসামঞ্জস্যপূর্ণ ভ্যাট ও কর নীতির কারণে উচ্চ করের বোঝা বহন করছেন। আমদানি পণ্যের উপর অ্যাডভান্স ট্যাক্স ও ভ্যাট ব্যবসায়ীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
কাস্টমস ও আমদানি প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি:
কাস্টমস কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি ও আমদানি প্রক্রিয়ায় জটিলতা ব্যবসায়ীদের জন্য বড় বাধা।
পণ্যের মূল্যায়নে অসামঞ্জস্যতা ও অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণ। যেমন- বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে Flat-Rolled Product or iron or non-allo– steel, of a width of 600 mm or more, hot-rolled, not clad, plated or coated (MS Plate)পণ্যের বাজার বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারের দর প্রতি মেট্রিক টন সর্বোচ্চ ৫২০ থেকে ৫৫০ মার্কিন ডলার। কিন্তু বাংলাদেশ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পণ্যটির শুল্কায়ন সেকশন থেকে মূল্য ৭২০ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করে রেখেছে যা অন্যায্য এবং আমদানী পর্যায়ে অর্থ পাচারকে উৎসাহিত করছে।
ভ্যাট ও ট্যাক্স সংক্রান্ত ন্যায্য প্রতিযোগিতা নিশ্চিতকরণ। যেমন-আমরা কাঁচা মাল আমদানীর ক্ষেত্রে VAT ১৫%, AT ৩% এবং AIT ৫% হারে প্রদান করে আসছি। Finished Product বিক্রয়ের সময় মূল্য ভিত্তির (উপরকরণ সহ) ১৫% VAT প্রদান করছি, যাহা মুসক ৬.৩ এর মাধ্যমে সমন্বয় করা হচ্ছে। এছাড়াও উৎপাদন প Adition সহ ট্রেজারী চালানের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করছি। মূল্য অনুমোদনের জন্য যখন Value Declare করা হয় তখন অনুমোদনের সময় Value Addition International Standard এর চেয়ে অনেক বেশী দিয়ে অনুমোদন করা হয়। এ জন্য আমাদের মূল্য অনেক বেড়ে যায়। ফলে বিদেশী কোম্পানী এবং আমাদের দেশের যে সকল কোম্পানী VAT, Tax পরিশোধ না করে ব্যবসা করছে তাদের সঙ্গে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছি না।এমতাবস্থায়, আমাদেরকে International Standard এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের মূল্য অনুমোদনের জন্য অনুরোধ করছি। ও-ইবধস এর ক্ষেত্রে ২০%, Purlin ১৫%, Deck sheet ১৫%, Color sheet ১৫%, মূল্য সংযোজন করার জন্য প্রস্তাব করছি।
ব্যাংকিং খাতের অব্যবস্থাপনা:
উচ্চ সুদের হার ও ঋণ প্রাপ্তিতে জটিলতা ব্যবসায়ীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা ব্যবসায়ীদের আস্থা হারানোর কারণ।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির উচ্চ মূল্য:
শিল্প কারখানাগুলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানির উচ্চ মূল্যের কারণে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা:
ডলারের বাজার অস্থিরতা ও আমদানি পণ্যের দাম বৃদ্ধি ব্যবসায়ীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
উত্তরণের উপায়:
কর ও ভ্যাট নীতি সংস্কার: ব্যবসায়ীদের জন্য কর ও ভ্যাটের হার সহনীয় পর্যায়ে আনুন। আমদানি পণ্যের উপর অ্যাডভান্স ট্যাক্স ও ভ্যাট প্রত্যাহার করুন। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির জন্য ইনকাম ট্যাক্স রেট কমানো। সেলারি বাবদ অতিরিক্ত পারকুইজিট বাতিল বা লিমিট বৃদ্ধি করা। প্রমোশনাল খরচের লিমিট তুলে দেওয়া, কারণ এটি ব্যবসার প্রকৃত খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। উৎসে আয়কর ৫% থেকে কমিয়ে ২% করা, কারণ অনেক ব্যবসার জন্য ৫% মুনাফা অর্জন সম্ভব নয়। প্রকিউরমেন্ট প্রোভাইডারের ভ্যাট ১০% থেকে কমিয়ে ৫% করা, যাতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন না হন।
কাস্টমস প্রক্রিয়া সহজীকরণ: কাস্টমস কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি বন্ধ করুন। পণ্যের মূল্যায়নে আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের সাথে সামঞ্জস্য আনুন। রপ্তানি পর্যায়ে শুল্ক প্রত্যর্পণ ((DEDO)) দ্রুত ও সহজতর করতে হবে। রপ্তানির জন্য শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির অনুমতি দিতে হবে। জধি Raw Materials আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কহার হ্রাস ও কর অব্যাহতি দিতে হবে।
ব্যাংকিং খাত সংস্কার: ব্যবসায়ীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা প্রদান করুন। ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা দূর করুন। ব্যাংক ঋণের সুদহার কমানো ও আর্থিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনুন।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য হ্রাস: শিল্প কারখানাগুলোর জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনুন।
বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীলতা: ডলারের বাজার স্থিতিশীল করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন। রপ্তানি আয় বৃদ্ধির জন্য নতুন বাজার সৃষ্টি করুন।
খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি উন্নয়ন:
কৃষকদের জন্য ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে সিন্ডিকেট ব্যবস্থা বন্ধ করুন। কৃষি উপকরণের উপর ভ্যাট ও ট্যাক্স হ্রাস করুন। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন (জ্উ) বাজেট বাড়ান। প্রান্তিক কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা প্রদান করুন।
সুপারিশ: সরকারি ক্রয় নীতিমালা সংশোধন করে কৃষকদের সরাসরি বাজার সুবিধা প্রদান করুন। কৃষি পণ্যের সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের জন্য আধুনিক অবকাঠামো গড়ে তুলুন।
শিল্প ও বস্ত্র খাত উন্নয়ন :
দেশীয় শিল্প রক্ষায় আমদানি নির্ভরতা কমাতে কার্যকরী বাজেট নীতি প্রণয়ন করুন। বস্ত্র শিল্পের কাঁচামালের উপর অ্যাডভান্স ট্যাক্স ও ভ্যাট প্রত্যাহার করুন। বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে দেশীয় শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক ক্ষমতা বৃদ্ধি করুন।
সুপারিশ: শিল্প খাতে অব্যবস্থাপনা দূর করতে ব্যাংকিং খাতের সংস্কার করুন। শিল্প কারখানার জন্য জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখুন। দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে সরকারি প্রকল্পে অগ্রাধিকার দিয়ে স্থানীয় জনবলের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা।
আবাসন ও অবকাঠামো উন্নয়ন:
নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করুন। আবাসন খাতের উন্নয়নে ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানো প্রয়োজন।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (চচচ) মডেলে আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করুন। শহর ও গ্রামীণ এলাকায় অবকাঠামো উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করুন।
স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়ন:
জাতীয় চিকিৎসা কমিশন গঠন করে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার করুন। চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধের উপর কর হ্রাস করুন। সরকারি হাসপাতালগুলোর সেবার মান উন্নত করুন।
গ্রামীণ এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা সুবিধা সম্প্রসারণ করুন। চিকিৎসা শিক্ষার মান উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করুন।
শিক্ষা খাত উন্নয়ন:
শিক্ষা উপকরণের উপর কর হ্রাস করুন। জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করুন। শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করুন।
সুপারিশ:
প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করুন। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও গবেষণার জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ দিন।
বেকারত্ব ও কর্মসংস্থান:
বন্ধ শিল্প কারখানা পুনরায় চালু করে বেকারত্বের হার কমানো প্রয়োজন। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা প্রদান করুন।
সুপারিশ:
দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করুন। তথ্য প্রযুক্তি ও ডিজিটাল ইকোনমিতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির উদ্যোগ নিন। প্রশিক্ষণ সুবিধা বাড়াতে সরকারি উদ্যোগে কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি করুন।
বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ও রেমিটেন্স:
রেমিটেন্স বৃদ্ধির জন্য টাকা পাচার বন্ধ করুন। ডলারের বাজার স্থিতিশীল করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন। রেমিটেন্স যোদ্ধা বা প্রবাসীদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।
রেমিটেন্স প্রেরণে প্রণোদনা বৃদ্ধি করুন। রপ্তানি আয় বৃদ্ধির জন্য নতুন বাজার সৃষ্টি করুন।
সামাজিক নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য বিমোচন:
দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদার করুন। নারী ও শিশুদের জন্য বিশেষ সহায়তা কর্মসূচি চালু করুন।
সুপারিশ: দারিদ্র্য বিমোচনে মাইক্রোফাইন্যান্স ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহায়তা প্রদান করুন। গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করুন।
আইবিডব্লিউএফ এর এই দাবি ও সুপারিশসমূহ আগামী বাজেটে প্রতিফলিত হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, ব্যবসায়ীদের সমস্যা সমাধান ও জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। সরকারের প্রতি অনুরোধ, এই প্রস্তাবনাগুলো বিবেচনা করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও উন্নয়নমুখী বাজেট প্রণয়ন করা হোক।