খাইরুল ইসলাম:: অর্থনৈতিক বাস্তবতা, বাজেট প্রস্তাবের দিকনির্দেশনা এবং নীতিনির্ধারণের জটিল স্তরগুলো নিয়ে নেত্রকোণা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ আয়োজন করেছিল এক অনন্য সেমিনার—‘National Budget for FY2025–26 and the Stylized Facts’। ৩১ জুলাই অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গবেষক ও উন্নয়ন ভাবনায় আগ্রহী অংশগ্রহণকারীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অর্থনীতিবিদ তৌফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘২০২৫ অর্থবছরের শুরুতে দেশের অর্থনীতি ছিল এক ধরনের দ্বিধা ও সংকটের আবর্তে। রাজস্ব আদায়ের হার হ্রাস পেয়েছিল, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ছিল বাস্তবায়নে ধীর, ব্যাংক খাতে চর্চা চলছিল অনাস্থার, আর সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন করে তুলেছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি।’ তবে বছরের শেষে কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে—রেমিট্যান্স বেড়েছে, রপ্তানি আয় ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে এসেছে একধরনের কাঙ্ক্ষিত স্থিতিশীলতা। তিনি মনে করিয়ে দেন, বাজেটের টেকসই প্রভাব বিচার করতে গেলে শুধুই পরিসংখ্যান নয়, তার প্রেক্ষাপট, প্রণয়নের প্রক্রিয়া এবং জনগণের প্রয়োজনীয়তার প্রতিফলন বিশ্লেষণ করাও জরুরি। বিশেষভাবে তিনি হতাশা প্রকাশ করেন, বাজেটে কর্মসংস্থান, শ্রমবাজার এবং বেকারত্ব নিয়ে তথ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি আজও রয়ে গেছে।
সেমিনারের প্রধান অতিথি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. খন্দকার মোহাম্মদ আশরাফুল মুনিম একটি বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি সামনে আনেন। তাঁর মতে, ‘একটি বাজেটকে বিচার করতে হলে কেবল অতীতের পরিসংখ্যান দিয়ে নয়, বরং বুঝতে হয় সময়ের চাপ, বৈশ্বিক অর্থনীতির টানাপোড়েন, এবং দাতা সংস্থার শর্তনির্ভর সীমাবদ্ধতা। আজকের সরকারকে সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি ভর্তুকি কিংবা শিক্ষা খাতে ব্যয় কমাতে হচ্ছে কখনও কখনও বাধ্য হয়েই। এই চাপের বাস্তবতা না-বুঝে বিশ্লেষণ করলে আমরা ন্যায়সঙ্গত মূল্যায়ন করতে পারি না।’
বিশেষ অতিথি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক ড. আনিছা পারভীন আলোচনাকে আরও বাস্তবমুখী করে তোলেন। তিনি বলেন, ‘অর্থনীতি মানে কেবল নীতির কাগজে ছাপা কিছু সংখ্যা নয়—এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কৃষকের ক্লান্ত কাঁধ, শ্রমিকের ঘামে লেখা দিন, এবং গ্রামীণ নারীর চোখে দেখা অনিশ্চয়তার ভবিষ্যৎ।’তিনি জোর দেন খাদ্য সংরক্ষণের জন্য হিমাগার নির্মাণের ওপর—‘উৎপাদন বাড়ছে, কিন্তু সংরক্ষণের অবকাঠামো না-থাকলে সেই শ্রমের ফল নষ্ট হয়। এতে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বাড়ে বৈষম্যও। বাজেটে এসব মৌলিক চাহিদার প্রতি যত্নবান হতে হবে।’
অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান জনাব শোভন রায় অনুষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে সমগ্র আলোচনার ধারা মনোনিবেশের সঙ্গে পরিচালনা করেন। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রভাষক জনাব সামিয়া জাহান, যার সুবিন্যস্ত ও সময়োপযোগী উপস্থাপনা সেমিনারকে একটি অর্থবহ গতি দেয়।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ের সক্রিয় অংশগ্রহণে আলোচনা ঘনীভূত হয়ে ওঠে। প্রশ্নোত্তর পর্বে শিক্ষার্থীরা সরাসরি প্রশ্ন রাখেন বাজেট বাস্তবায়নের সমস্যা, বেসরকারি বিনিয়োগ, মুদ্রাস্ফীতি ও গ্রামীণ দারিদ্র্য নিয়ে। এর ফলে সেমিনার হয়ে ওঠে এক উন্মুক্ত বুদ্ধিবিনিময়ের পরিসর, যেখানে চিন্তার আদান-প্রদান হয় উভয় দিক থেকে।














