খাইরুল ইসলাম:: বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির দুই মহান স্রষ্টা—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্বমানবতার মাধুর্যে আমাদের চেতনাকে ভিজিয়েছেন, আর নজরুল তাঁর বিদ্রোহী আগুনে জাগিয়েছেন সংগ্রামের অঙ্গীকার। একজনের কণ্ঠে শান্ত সুরের অমৃতধারা, অন্যজনের কণ্ঠে বজ্রনিনাদিত বাঁশির ডাক। তাঁদের এই মিলনেই বাংলা সংস্কৃতি পেয়েছে বৈশ্বিক দীপ্তি, পেয়েছে মুক্তির গান ও জীবনদর্শনের অমোঘ শক্তি। এই ঐতিহ্যকে ধারণ করতেই আজ বিকাল ৪টায় নেত্রকোণা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত হলো ‘রবীন্দ্র-নজরুল স্মরণানুষ্ঠান-২০২৫’।
নেত্রকোণা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ্, নেত্রকোণা জেলা শাখার যৌথ আয়োজন শুরু হয় শতাধিক কণ্ঠের সমবেত জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে—যেন সুরের মূর্ছনায় একাকার হয়ে যায় সমবেত প্রণাম। সেই সুরের পরশ গায়ে মেখে শুরু হয় আলোচনা সভা, যার প্রতিপাদ্য ছিল—‘একই বৃন্তে ফোটা দুটি ফুল : রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল’। আলোচনায় অংশ নেন—অধ্যাপক ড. আনিছা পারভীন, ট্রেজারার, নেত্রকোণা বিশ্ববিদ্যালয়; অধ্যাপক আফজালুর রহমান, প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, নেত্রকোণা সরকারি কলেজ; ড. শরমিন্দ নীলোৎপল, অধ্যাপক, স্কুল অব ফার্মাসি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি; জনাব সুমা রানী রায়, সহযোগী অধ্যাপক, সংগীত বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ এবং অ্যাডভোকেট পূরবী কুণ্ড, সভাপতি, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিষদ্, নেত্রকোণা জেলা শাখা। তাঁদের আলোচনায় উঠে আসে—এই দুই অমর স্রষ্টার সাহিত্য ও সংগীত শুধু সৌন্দর্য ও আবেগের নয়, বরং এটি সমাজের হৃদয় স্পর্শ করে, মানবজীবনের অমোঘ শিক্ষা বহন করে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মিলিত সৃষ্টিতে আমরা শিখি—প্রেমের কোমল সুর আর বিদ্রোহের তীব্র তান, শান্তির নরম ছোঁয়া আর সংগ্রামের বজ্রধ্বনি, শিল্পের মাধুর্য আর মানবতার দীপ্তি—সবই মিলিত হয়ে গড়ে তোলে বাংলার সাংস্কৃতিক ও মানবিক ঐতিহ্য। আজকের এই আয়োজন শিক্ষার্থীদের মনে সেই চেতনা ও প্রেরণা জাগায়, যা নতুন প্রজন্মকে আলোকিত করে মানবতা, স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার পথে এগিয়ে যেতে।
সভায় সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. খন্দকার মোহাম্মদ আশরাফুল মুনিম। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাণস্পন্দন। তাঁদের চেতনা আজও সমকালীন, কারণ তারা মানুষের মাঝে বেঁচে থাকা স্বাধীনতা, সাম্য ও মানবিকতার বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন। এই আয়োজনের মূল লক্ষ্য হলো নতুন প্রজন্মকে তাঁদের সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সাংস্কৃতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা এবং মানবতার পথচলায় আলোকবর্তিকা হিসেবে তাঁদের চিন্তাকে সামনে আনা।’ স্বাগত বক্তব্য দেন জনাব সাইদাতুস সাবা, প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ, নেত্রকোণা বিশ্ববিদ্যালয়।
স্মরণানুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে মঞ্চে ‘ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়’ শীর্ষক সংগীতানুষ্ঠান উদ্ভাসিত হয়, যা সুরের সোনালি ছোঁয়ায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। পরিবেশনায় ছিলেন ওস্তাদ স্বপন কুমার সরকার, দৃষ্টি সাহা রায় এবং মৌমিতা ধর। এছাড়াও অংশ নেন নেত্রকোণা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এবং জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ্, নেত্রকোণা জেলা শাখার শিল্পীবৃন্দ, যারা সংগীত ও শিল্পের মাধুর্যে পুরো পরিবেশনায় প্রাণের আবহ সঞ্চার করেন।
আলোচনা ও সংগীতের এই দুই পর্ব মিলিত হয়ে অনুষ্ঠানকে করেছে সম্পূর্ণ—যেখানে রবীন্দ্র-নজরুলের চেতনার দীপ্তি মানুষের মনে কল্পনার দীপ জ্বালায়, এবং সংস্কৃতি ও মানবতার অমোঘ পথকে সামনে আনে।