আইয়ুব আলী, ময়মনসিংহ :: মান্ধাতার আমলের পদ্ধতিতে স্থাপিত ব্রীক্স ফিল্ডের চিমনি দিয়ে কালো ধোয়া নির্গত হয়। এতে মারাত্মকভাবে দুষিত হয় বাতাস জীবনের জন্য হুমকি ও বিপর্যয়কর নেতিবাচক প্রভাব পরে বায়ুমন্ডলে। ব্যাহত হয় মানুষের সুস্থ স্বাভাবিক জীবন, স্বাস্থ্যর জন্য তৈরি হচ্ছে নানা সঙ্কটের। গবেষনায় জানা যায়, ইটভাটার কালো ধোয়া মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই ধোয়ায় বিদ্যমান থাকে মিথেন, দুষিত কার্বন ডাই অক্সাইড এবং নাইট্রাস অক্সাইড নামক তিনটি ক্ষতিকর পর্দাথ। এটি শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের রোগ, অ্যালার্জি, এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও, শিশুদের জন্য এটি আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। পরিবেশ, সুস্থ এবং সুরক্ষিত জীবনের জন্য ইটভাটায় সৃষ্ট পরিবেশের বিপর্যয় এড়াতে পরীক্ষামুলকভাবে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার কুষ্টিয়া নামাপাড়ায় একটি ইট ভাটায় স্থাপিত হয়েছে উদ্ভাবক আলী হোসেনের র্কাবো-পিউরিফিকেশন টেকনলজি, (সিপিটি) “ ইট ভাটায় কার্বন পিউরিফিকেশন প্লান্ট। এই প্লান্ট স্থাপনের ফলে উৎপাদন খরচও কিছুটা কমে।প্লাট স্থাপন ব্যয় মাত্র ৩০ লাখ টাকা।
২০২০ সালে কার্বন পিউরিফিকেশন প্লান্ট”নামে পরিবেশ বান্ধব“ প্লান্ট তৈরির পর উদ্ভাবক আলী হোসেন প্রকল্পটির পাইলটিং শুরু করেন ২০২২ সালে। পরে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পরীক্ষামুলকভাবে তার প্লান্ট স্থাপন শুরু করেন ইটভাটা মালিকগন। তাদের একজন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার “এবিসি ব্রীক্স” মালিক রুহুল আমিন। তিনি ২ একরের একটি ভাটায় এই প্ল্যান্ট স্থাপন করেছেন । সেই ভাটায় গিয়ে দেখা যায়, দুটি চিমনি। একটি মান্ধতার আমলের অন্যটি আধুনিক চিমনি। তবে মান্ধাতার আমলের চিমনিটি বন্ধ। পাশেই আলী হোসেনের আধুনিক চিমনি দিয়ে বের হচ্ছে পরিবেশ বান্ধব সাদা শীতল বাস্প। এটি মুলত: আট চেম্বার বিশিষ্ট আন্ডার গ্রাউন্ড একটি পানি প্রবাহ বা ওয়াটার স্প্রে চ্যানেল। যে চ্যানেল দিয়ে কার্বন মিশ্রিত কালো দুষিত পানি ওয়াটার স্প্রে চ্যানেলের মাধ্যমে পরিশোধিত হয়ে থাকে। ফলে কালো ধোয়ার পরিবর্তে আলী হোসেনের আধুনিক চিমনি দিয়ে সাদা ও শীতল বাস্প আকারে বের হয়ে মিশে যাচ্ছে বায়ুমন্ডলে। ফলে সেই ব্রীক্সফিল্ডের কালো ধোয়া দ্বারা আর পরিবেশ দুষন হচ্ছে না।অন্যদিকে কার্বন মিশ্রিত পানি ফিল্টারের মাধ্যমে পরিশোধিত হয়ে একটি চৌবাচ্চায় গিয়ে পড়ে। সেখানে জমা হচ্ছে কার্বনের গাদ। সে গাদ আহরোন করে তা আবার পুনরায় ভাটায় ব্যবহার করছে ভাটা মালিক। তাতে মালিকের উৎপাদন খরচও কমছে বেশ।
উদ্ভাবক আলী হোসেন বলেন, ২০২১ সালে তার উদ্ভাবিত র্কাবো-পিউরিফিকেশন টেকনলজি, (সিপিটি) প্লান্ট শিল্প মন্ত্রনালয় কর্তৃক “প্যাটেন্ট” মালিকানা স্বত্ব পান। এর পর পর পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের আদেশে গঠিত পরিবেশ অধিদপ্তর পাচ সদস্য বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ কমিটি তার প্ল্যান্টের কারিগরি কার্যক্ষমতা যাচাই বাছাই করে ইতিবাচক প্রতিবেদন প্রদান করে। পরে ২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারীতে পরিবেশ মন্ত্রনালয় পরিবেশ সুরক্ষা বান্ধব বিধায় বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারক মালিকে সমিতিকে আলি হোসের প্লান্ট ব্যহারের জন্য পত্র দেন।
উদ্ভাবক আলী হোসেন বলেন, বানিজ্যিকভাবে তার প্লান্ট বাজারজাত করে মুনাফা তোলাই তার উদ্যেশ্য নয়। পরিবেশ বান্ধব উন্নত প্রযুক্তি কার্বো-পিউরিফিকেশন টেকনোলজি (সিপিটি) শিল্প কলকারখানায় ও ইট ভাটায় স্থাপন করলে কারখানার নির্গত কালো ধোঁয়া ওয়াটার স্প্রে প্লান্ট এর মাধ্যমে ফিল্টারিং করে জিরো কার্বনে বায়ু দূষণমুক্ত সাদা শীতল বাষ্প পরিবেশবান্ধব নতুন চিমনি দিয়ে ছাড়া হবে। তাতে কারখানার নির্গত বায়ু দূষণের মান মাত্রা সহনীয় মাত্রার ভিতরে থাকবে। (সিপিটি) স্থাপনের কারণে আন্যসব কারখানা গুলোও পরিবেশবান্ধব হবে এবং নির্গত কালো ধোঁয়ার ক্ষতিকর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে, স্থানীয় জন সাধারণ মুক্তি পাবে। কৃষির কোন ক্ষতি সাধন হবে না। পশু পাখির বাসস্থান ঠিক থাকবে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কবল থেকে দেশ ও জাতি রক্ষা পাবে এবং সবুজ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণ হবে। কারখানার, পরিবেশ সুরক্ষা হলে। পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র / নবায়ন সহজে পাওয়া যেতে পারে। কোন আইনি জটিলতা ছাড়াই নির্দ্বিধায় ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করা যাবে।তাছাড়া এই প্লাট স্থানে খরচ হবে মাত্র ৩০ হাজার টাকা।
এবিষয়ে ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববাদ্যায়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড মুরাদ আহমেদ ফারুক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সয়েল ইকোলজি এন্ড ফার্টিলিটি ল্যাবে পরীক্ষান্তে দেখা গেছে সেই ইটভাটার কালো প্রথম ধাপের চেম্বারের নমুনায় পাওয়া ধোয়ায় দুষিত ক্ষুদ্রবস্তু কনার পরিমার পিএম ২.৫ সমান ৩১৪ মিলিগ্রাম পার লিটার। আর প্রথম ধাপের সাকনির পর সেই ধোয়ায় পাওয়া গেছে ২৩৭ পিপিএম ক্ষুদ্র বস্তিকণা। আর আট চেম্বার বা পানি ফিল্টার দিয়ে বিশুদ্ধ হয়ে আধুনিক চিমনি দিয়ে বের হওয়া সাদা ধোয়া থেকে বের হচ্ছে মাত্র ৩২ মিলিগ্রাম পার লিটার। পরীক্ষান্তে দেখা গেছে পুরাতন চিমনিতে প্রথম ধাপে ৭৪৭ মিলিগ্রাম পার লিটার মিথেন নির্গত হত। সেখানে আট চেম্বারের ফিল্টারিং করার পর ৯০ শতাংশ মিথেন নির্গমন হ্রাস পেয়েছে। একই ভাবে পুরাতন চিমনি দিয়ে যেখানে ১১ হাজার ৮শ ২২ পিপিএম কার্বন ডাই অক্সাইড বের হত সেখানে আধুনিক চিমনি দিয়ে বের হচ্ছে মাত্র ৩ হাজার ৭৭৬ পিপিএম অর্থা পরীক্ষার আগের চেয়েৎ ৩২ শতাংশ কম।
অন্যদিকে নাইট্রাস অক্সাইড প্রথমে বের হত ৭ পিপিএম আর আধুনিক চিমনি দিয়ে বের হচ্ছে মাত্র ৩পিপিএম অর্তাৎ ৫০ শতাংশ কম নাইট্রাস অক্সাইড বের হচ্ছে। উপরোক্ত তিনটি উপাদান বায়ু মন্ডলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে। বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন রাখতে আলী হোসেনের প্লাট ইট ভাটায় ব্যবহারে মত দেন এই বিজ্ঞানী। এই বিজ্ঞানীর মত, দেশে প্রায় সাড়ে আট হাজার ইট ভাটা রয়েছে।এই ইটভাটাগুলো বায়ু দুষনের জন্য প্রায় ৫৮ শতাংশ দায়ী।উদ্ভাবিত প্লাট ব্যবহারের ফলে বায়ুমন্ডল দুষন কমবে ৫৮ শতাংশ।