খাইরুল ইসলাম:: নেত্রকোণা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা’ শীর্ষক এক গভীর মননভিত্তিক আলোচনা সভা। এই আলোচনায় উচ্চশিক্ষার কাঠামো, নৈতিকতা ও ভবিষ্যত ভাবনা একবিন্দুতে মিলিত হয়ে উঠল; যেখানে ইতিহাসের অভিঘাত মিশেছে নীতিনির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা ও তরুণদের বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনায়।
সভায় সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. খন্দকার মোহাম্মদ আশরাফুল মুনিম। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থান কেবল রাজনৈতিক জাগরণ নয়—এটি উচ্চশিক্ষার পরিসরকে নতুন প্রশ্নে, নতুন দায়ে দাঁড় করিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর নিছক শিক্ষার জায়গা নয়, বরং হয়ে উঠছে রাষ্ট্র, সমাজ ও মানুষের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবার কেন্দ্র।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, পিএইচডি, মুখ্য আলোচক হিসেবে এক বিশ্লেষণধর্মী বক্তব্যে বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ছিল এক সামগ্রিক নেতৃত্বের ফল। এখানে কোনো মাস্টারমাইন্ড নেই, একক নেতৃত্বও নেই। এটি জনতার চেতনা, অভিজ্ঞতা ও বিরোধের সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশ।’ তিনি বলেন, ‘আমি এই আন্দোলনকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলতে রাজি নই। এটা মহান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে খর্ব করে। এটি ছিল এক গণআন্দোলন—যেমনটি হয়েছিল ১৯৯০ সালে। এটিকে স্বাধীনতার পুনরাবৃত্তি বলা রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা ছাড়া আর কিছু নয়।’
তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার ছায়া। দেশের বিভিন্ন জেলায় একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রকল্প প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এগুলো প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রক্রিয়া নয়—এটি ছিল দলীয় মাস্তানি কাঠামো প্রতিষ্ঠার অংশ। যেখানে গবেষণা বা শিক্ষার মান নয়, বরং রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনই মুখ্য হয়ে ওঠে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের উচ্চশিক্ষা বাজেটের বণ্টনও রাজনৈতিক। শিক্ষার নামে এই অসম নীতিমালা চলতে পারে না। আওয়াজ তুলতে হবে—বাজেট হওয়া উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তব প্রয়োজন, একাডেমিক লক্ষ্য ও গবেষণার ভিত্তিতে।’
বিশেষ আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ড. আনিছা পারভীন। তিনি বলেন, ‘উচ্চশিক্ষা কেবল কোনো পেশার প্রস্তুতি নয়, এটি মানবিকতা ও নৈতিকতার এক দীপ্ত জ্যোতি। বিশ্ববিদ্যালয় হতে হবে সেই আলোকবর্তিকা—যেখানে শুধু জ্ঞান অর্জন নয়, গড়ে ওঠে স্বাধীনচেতা ও দায়িত্বশীল নাগরিক, যারা সত্যিকারের বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণে নেতৃত্ব দিতে পারে।”
আলোচনার আহ্বায়ক মো. সামজীর আহমেদ স্বাগত বক্তব্যে বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন একটি প্রশ্নচিহ্ন রেখে গেছে—আমরা কি সত্যিই এমন এক কাঠামো গড়তে পারছি, যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষার পরিবেশ আছে?’ অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক জনাব সামিয়া জাহান।
শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন নাফিস সাদমান (ইংরেজি বিভাগ), নূর-ই জান্নাত (বাংলা বিভাগ), রাজিব মিয়া (কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ) এবং রিফাত রেজওয়ান জয় (অর্থনীতি বিভাগ)। তাঁদের কণ্ঠে প্রতিফলিত হয় এক নতুন উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন—যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে চিন্তার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের সুযোগ, ও ন্যায়বিচারের চর্চার জায়গা।
শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের সক্রিয় উপস্থিতিতে সভাটি হয়ে ওঠে এক জীবন্ত সংলাপ—যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত একে অপরকে প্রশ্ন করে, আলো দেয়। এই আয়োজন শুধু আলোচনা নয়, একটি দৃষ্টিভঙ্গি—বিশ্ববিদ্যালয় কেমন হবে জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তী বাংলাদেশে? এটি কেবল একটি স্মৃতি নয়, বরং শিক্ষাব্যবস্থার নৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তিকে নতুন করে নির্মাণের চেতনা।
নেত্রকোণা বিশ্ববিদ্যালয় অস্থায়ী ক্যাম্পাস ছেড়ে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে আজ স্থায়ী ক্যাম্পাসে নতুন ক্যাফেটেরিয়া উদ্বোধন করা হয়েছে। এটি ছিল আজকের অনুষ্ঠানটির দ্বিতীয় পর্ব, যেখানে ক্যাম্পাসে উন্নত সুযোগ-সুবিধার দিকে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গৃহীত হলো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. খন্দকার মোহাম্মদ আশরাফুল মুনিম, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, পিএইচডি, ও ট্রেজারার ড. আনিছা পারভীন উপস্থিত থেকে ক্যাফেটেরিয়া উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে পায়রা ওড়ানো হয়, যা নতুন স্বাধীনতা ও সম্ভাবনার প্রতীক হয়ে ওঠে।
ক্যাফেটেরিয়া পরিদর্শনের পাশাপাশি বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে আজকের আয়োজনের সমাপ্তি ঘটে। বৃক্ষরোপণ সেই আশার প্রতীক, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে আরও সবুজায়িত করবে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য শান্তিপূর্ণ অধ্যয়নক্ষেত্রের সৃষ্টি করবে।
এই পদক্ষেপ স্বচ্ছন্দ, আধুনিক ও প্রাণবন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পথে নেত্রকোণা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি ও স্থায়ী ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু স্থানান্তরের লক্ষ্যে নেওয়া এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।