ব্রাজিলের বেলেমে জাতিসঙ্ঘের কপ৩০ জলবায়ু সম্মেলনের পর্দা উঠেছে আজ। স্থানীয় সময় সোমবার সকাল ১১টায় এবং বাংলাদেশ সময় সোমবার মধ্যরাতে (২টায়) জাতিসঙ্ঘের ৩০তম জলবায়ু সম্মেলন—কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ (কপ৩০) শুরু হয়েছে।
আমাজন বনাঞ্চলের পাদদেশে বেলেম শহরের হ্যাঙ্গার কনভেনশন অ্যান্ড ফেয়ার সেন্টার অব দ্য অ্যামাজনের প্লেনারি অ্যামাজোনাস হলে প্রায় ১৯০টি দেশের প্রতিনিধি, সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এই বিশ্ব সম্মেলনে যোগ দেবেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেবেন কপ২৯-এর সভাপতি ও আজারবাইজানের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মুকতার বাবায়েভ, কপ৩০-এর মনোনীত সভাপতি ব্রাজিলের সরকারি পরিবেশ, জলবায়ু নীতি ও স্থায়ী উন্নয়ন বিষয়ক নীতি প্রণয়নে জড়িত থাকা আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগো এবং জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক নির্বাহী সচিব সাইমন স্টিল।
এর আগে, মূল সম্মেলনের পূর্ববর্তী আলোচনার অংশ হিসেবে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের ‘বেলেম ক্লাইমেট সামিট’ অনুষ্ঠিত হয় ৬ ও ৭ নভেম্বর। দুই দিনের এ শীর্ষ সম্মেলনে বৈশ্বিক জলবায়ু পদক্ষেপ জোরদার এবং নির্গমন কমানোর বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা হয়।
কপ৩০ সম্মেলনে বিশ্বের প্রায় ১৯০টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন, যেখানে জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন নির্বাহী সচিব সিমন স্টিয়েল কপ৩০ সম্মেলনের আগের রাতে গতকাল রোববার (ব্রাজিলের স্থানীয় সময়) বলেন, প্যারিস (কপ২৬) চুক্তি ইতোমধ্যেই কার্যকর হচ্ছে, তবে আমাজনে জলবায়ু পদক্ষেপ আরও দ্রুত করা দরকার।
তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইতোমধ্যেই বড় ক্ষতি করছে- ক্যারিবিয়ানে হারিকেন মেলিসা, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনে সুপার টাইফুন, আর দক্ষিণ ব্রাজিলে টর্নেডো।’
স্টিয়েল তিনটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য উল্লেখ করেছেন যা কপ৩০-এ অবশ্যই অর্জন করতে হবে। সেগুলো হলো-সকল দেশের প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট করা যেমন- জলবায়ু সহযোগিতায় সবাই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা যেমন: সব অর্থনীতির সব খাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া এবং মানুষের জীবনের সাথে সংযোগ যেমন- জলবায়ু পদক্ষেপ যেন প্রত্যেকের জীবনে সুবিধা নিয়ে আসে – যেমন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, দূষণ কমানো, স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও নিরাপদ, সাশ্রয়ী শক্তি।
তিনি আরো বলেন, ‘এটি তার চতুর্থ কপ, এবং প্রতিটি সম্মেলনে দেশগুলো পার্থক্য পার হয়ে সফল ফলাফল দিয়েছে।’
বক্তব্যের শেষে বলেন, ‘চলুন কাজ শুরু করি।’
জানা যায়, ব্যয়, সময়সহ সামগ্রিক বিবেচনায় এ বছর বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই জলবায়ু সম্মেলনে ছোট সরকারি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। এবারই প্রথম মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় যুক্ত হয়েছে। সব মিলে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধি দলের সদস্য ১৫ জনের বেশি নয় বলে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণায়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (ইউএনএফসিসিসি) অধীনে আয়োজিত এ সম্মেলনে দেশের প্রতিনিধি, রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, এনজিও কর্মী ও গণমাধ্যমকর্মী অংশ নেবেন। অ্যামাজন অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জলবায়ু সম্মেলনটি আগামী ২১ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে। সম্মেলন উপলক্ষে ব্রাজিলের বিভিন্ন শহর ও পর্যটন এলাকা আকর্ষণীয়ভাবে সাজানো হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, এনজিও কর্মীসহ অংশীজনেরা ব্রাজিলে প্রবেশ করেছেন।
জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (ইউএনএফসিসিসি) অধীনে আয়োজিত এ সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের সরকারের পাশাপাশি পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, এনজিও কর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীরা অংশ নিচ্ছেন। অ্যামাজন অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জলবায়ু সম্মেলনটি আগামী ২১ নভেম্বর শেষ হবে। সম্মেলন উপলক্ষে ব্রাজিলের বিভিন্ন শহর ও পর্যটন এলাকা আকর্ষণীয়ভাবে সাজানো হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, এনজিও কর্মীসহ অংশীজনেরা ব্রাজিলে প্রবেশ করেছেন।
প্যারিস চুক্তির (২০১৫) পর এবারের কপ-৩০ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু সম্মেলন, যেখানে দেশগুলোকে ২০৩৫ সালের মধ্যে নির্গমন কমানোর নতুন পরিকল্পনা জমা দিতে হবে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা বলেছেন, ‘বেলেম হবে সত্যিকারের কপ, যেখানে শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তব কাজের রূপরেখা তৈরি হবে।’
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা ও খরার প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি খাত মারাত্মক ঝুঁকিতে। তাই জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি, খাদ্যনিরাপত্তা ও টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ সম্মেলনে জোরালো প্রস্তাব তোলা হবে বলে জানা যায়।
কপ৩০-এর মূল লক্ষ্য হলো বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা; প্রতিটি দেশের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) বা জলবায়ু লক্ষ্য হালনাগাদ করা; জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন এবং ক্ষতি-ক্ষতির (লস অ্যান্ড ড্যামেজ) তহবিল বাস্তবায়নে অগ্রগতি এবং ২০২৫ সাল পরবর্তী জলবায়ু চুক্তির রূপরেখা নির্ধারণ করা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি হিসেবে কপ৩০-এ জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে জোরাল ভূমিকা রাখবে। জলবায়ু অভিযোজন, অর্থায়ন এবং ক্ষতি-ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা, স্বচ্ছতা ও দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মনে করে, উন্নয়নশীল ও জলবায়ু–ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য সময়োপযোগী ও অনুদানভিত্তিক সহায়তা নিশ্চিত না হলে বৈশ্বিক জলবায়ু লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।
প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিটি দেশকে প্রতি পাঁচ বছরে নিজেদের জাতীয় নির্ধারিত অবদান (এনডিসি – ন্যাশনালি ডিটারমাইনড কন্ট্রিবিউশন) আপডেট করে জমা দিতে হয়, যাতে গ্লোবাল তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫–২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা যায়।
২০৩৫ সালের মধ্যে নতুন বা আপডেট করা এনডিসি জমা দেয়ার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে দেশগুলো নির্গমন কমানোর পরিকল্পনা আরো উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও বাস্তবসম্মত করে।
এই পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো- গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো; পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবহার বাড়ানো; বন ও প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ এবং টেকসই ও সবুজ অর্থনীতি গড়ে তোলা।
অর্থাৎ ২০৩৫ সালের মধ্যে দেশগুলোকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর পদক্ষেপের পরিকল্পনা জমা দিতে হবে, যাতে বিশ্ব জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়। উন্নতবিশ্ব যেন প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থায়নের অঙ্গীকার পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করে এবং এই প্রতিশ্রুত অর্থ নিউ কালেক্টিভ কোয়ান্টিফাইড গোল নির্ধারণের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করার প্রস্তাব দিবে বাংলাদেশ। প্রস্তাব অনুযায়ী, ২০৩৫ সালের মধ্যে বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলার এবং মোট ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে। যেখানে অগ্রাধিকার পাবে অনুদান, অভিযোজন ও ক্ষতি-ক্ষতিপূরণ।
বাংলাদেশ বলেছে, জলবায়ু অর্থায়নে এলডিসিজ এসআইডিএস ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকারি অর্থের অন্তত ৫০ শতাংশ অভিযোজনের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে, যা অনুদান ও সরাসরি প্রবেশাধিকারের ভিত্তিতে প্রদান করতে হবে। অর্থায়নের প্রক্রিয়া হতে হবে সহজ, দেশীয়ভাবে নেতৃত্বাধীন ও সমন্বিত, যাতে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন ও মালিকানা অর্জন করতে পারে।
ঢাকা স্পষ্টভাবে বলছে, জলবায়ু অর্থায়ন হতে হবে ঋণের বদলে অনুদানভিত্তিক, যাতে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো নতুন ঋণ-সঙ্কটে না পড়ে।
এসব তহবিল দ্রুত পুনরায় পূরণ করে জাতীয় অগ্রাধিকার ও বৈশ্বিক কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাস্তবায়নের আহ্বান জানাবে বাংলাদেশ।













