খাইরুল ইসলাম:; আজ নেত্রকোণার আকাশে গোধূলির মেঘ যেন ভারী! হাওড়ের জলে তীব্র শোকের ঢেউ উঠেছে নিঃশব্দে! দুপুর পৌনে তিনটার সেই মুহূর্ত—ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শীতল কক্ষে নিভে গেল এক প্রজ্জ্বলিত নক্ষত্র, যার দীপ্তি বহু প্রজন্মের চিন্তাজলে দিগন্ত ছুঁয়ে ছিল। তিনি যতীন সরকার। যিনি শুধু একজন প্রাবন্ধিক নন, ছিলেন এই দেশের মুক্তবুদ্ধির অদম্য আলোর দিগন্ত। তাঁর মৃত্যু মানে হাওড়ের বুক থেকে এক পূর্ণিমার প্রতিচ্ছবি মুছে যাওয়া।
শৈশব থেকে জন্মমৃত্যুর দিগন্ত পর্যন্ত তিনি বহন করেছেন সমাজতন্ত্রের লাল পতাকার রোদ, ধর্মনিরপেক্ষতার স্বচ্ছ বাতাস, মার্কসীয় বিশ্লেষণের তীক্ষ্ণ আলো। সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা ছিল তাঁর প্রথম অঙ্কুর, আর পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন হয়ে উঠেছিল ইতিহাসের অন্দরমহল উন্মোচনের দর্পণ। তাঁর কলমে পাভলবীয় মনোবিজ্ঞান, ঐতিহাসিক-দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, আর ইহবাদী দার্শনিক চেতনা এক স্রোতে মিলেমিশে গড়েছে নতুন চিন্তার খাত।
কিন্তু তিনি শুধু লেখার মানুষ ছিলেন না—তিনি ছিলেন স্বপ্নের স্থপতি। নেত্রকোণার হাওড় ঘিরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন তিনি বহু বছর ধরে বুকে বুনেছেন, যেন বৃষ্টির অপেক্ষায় ধানক্ষেতে থাকা কৃষকের মতো। সেই স্বপ্ন পূর্ণ হলে তিনি বাংলা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন, হাতে তুলে দিলেন জ্ঞানের শস্যবীজ। তাঁর কাছে শিক্ষার্থীরা ছিল নদীর মতো—যাদের মুক্ত স্রোতধারায় তিনি শুধু দিকনির্দেশ দিয়েছিলেন, বাঁধ দেননি।
আজ তাঁর অনুপস্থিতি হাওড়ের বাতাসকে স্তব্ধ করেছে, আকাশকে করেছে নত, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণকে ভরিয়ে দিয়েছে গাঢ় নীরবতায়। ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. খন্দকার মোহাম্মদ আশরাফুল মুনিম এবং ট্রেজারার অধ্যাপক ড. আনিছা পারভীন গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছেন—যতীন সরকারের মতো মানুষ চলে গেলে দিগন্ত শূন্য হয়ে যায়, কিন্তু তাঁর চিন্তার আলো রয়ে যায় নক্ষত্রের মতো, যা পথ দেখায়।
নেত্রকোণা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার এই মননঋদ্ধ, প্রজ্ঞার অনন্ত শিখার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। যতীন সরকারের স্বপ্ন, কর্ম ও আলোর পথ আমরা বহন করব—যেন হাওড়ের জলে চিরস্থায়ী প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকে তাঁর স্মৃতি