মো: সানাউল্লাহ্ রিয়াদ: বাংলাদেশ একটি জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ, যেখানে প্রায় প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। এরমধ্যে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ও খরা অন্যতম। এসব দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকার স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিটি ইউনিয়নে গঠন করেছে ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি (টউগঈ), যা একটি আইনি কাঠামোর অংশ হিসেবে কাজ করার কথা। তবে বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, দেশের অধিকাংশ ইউনিয়নে এসব কমিটি কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে তারা নিষ্ক্রিয়, অকার্যকর বা বহু বছর ধরে সভা করে না, এমনকি সদস্যরা নিজেও জানে না যে তারা এই কমিটিতে আছে কি না!
ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির মূলত ভূমিকা এবং দায়িত্ব হল- স্থানীয় দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্র্ণ এলাকা ও ঝুঁকি চিহ্নিত করা; জনগণের মধ্যে ঝুঁকি মোকাবেলা বিষয়ক সচেতনতা তৈরি করা; বার্ষিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (অহহঁধষ অপঃরড়হ চষধহ) প্রণয়ন; বার্ষিক বাজেট প্রস্তাবনায় ১০% তাদের কর্মপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্তি; দুর্যোগের সময়, পূর্বে ও পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রম সমন্বয় করা; বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় কাজ করা।
তবে এ কমিটি নিষ্ক্রিয়তার কারণ হল- ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের অভাব; রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি; প্রশিক্ষণ ও বাজেটের অভাব; নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির অভাব; বার্ষিক পরিকল্পনা থাকলেও তা ইউনিয়ন পরিষদের বাজেটে প্রতিফলিত হয় না।
এরমধ্যে আবার লিঙ্গভিত্তিক ঝুঁকির অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। দুর্যোগকালে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও বয়স্ক ব্যক্তিরা অনেক বেশি ঝুঁকিতে থাকে। কিন্তু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নারীদের নেতৃত্বের সুযোগ খুবই সীমিত। টউগঈ-এর পুনর্গঠনের সময় এই লিঙ্গভিত্তিক ঝুঁকির অন্তর্ভুক্তি ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। তবে লিঙ্গভিত্তিক ঝুঁকি এড়াতে সমতা ও সহনশীলতা নিশ্চিতের কিছু কৌশল রয়েছে।
তবে নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার ও সন্তানদের রক্ষা করতে গিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা উপেক্ষা করেন। দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপত্তাহীনতা ও যৌন হয়রানির ঝুঁকি থাকে, যা নারী ও কিশোরীদের উপস্থিতি কমিয়ে দেয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণ প্রায় অনুপস্থিত থাকে, ফলে তাদের চাহিদা নীতিনির্ধারণে প্রতিফলিত হয় না।
এদিকে জাতীয় নীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২-এর মাধ্যমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছে। জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (ঘঅচ)-এ নারী-সংবেদনশীল অভিযোজন কার্যক্রমের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
টউগঈ-এ নারীর অন্তর্ভুক্তি আসলে কেন গুরুত্বপূর্ণ? স্থানীয় নারী প্রতিনিধি, নারী সিএসও সদস্য ও কমিউনিটি নারী নেতাদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করলে বাস্তব অভিজ্ঞতা ও চাহিদা পরিকল্পনায় প্রতিফলিত হয়। নারী সদস্যরা জল, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, আশ্রয় ও খাদ্য ব্যবস্থা বিষয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রয়োজনীয় তথ্য আনতে পারেন, যা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে আরও মানবিক করে তোলে। নারীদের নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ দুর্যোগ পূর্ব প্রস্তুতি, সাড়া প্রদান ও পুনর্বাসন কার্যক্রমকে আরও কার্যকর ও ন্যায়ভিত্তিক করে। তাই টউগঈ গঠন ও পুনর্গঠনের সময় কমপক্ষে ৩০% নারী সদস্য অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা। নারীদের জন্য আলাদা ক্ষমতায়নমূলক প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কার্যক্রম গ্রহণ। নারী নেতৃত্বকে সমর্থন করতে স্থানীয় পর্যায়ে সহযোগিতা ও মনোভাব পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া। দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নারী শুধু উপকারভোগী নয়, সক্রিয় অংশীদার। তাই লিঙ্গভিত্তিক ঝুঁকির অন্তর্ভুক্তি মানে শুধু সমতা নয়, বরং দুর্যোগ সহনশীল সমাজ গঠনের একটি অনিবার্য উপাদান।
টউগঈ যদি সঠিকভাবে বার্ষিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে, তাহলে সেটি ইউনিয়ন পরিষদের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার (অউচ) অংশ হওয়া উচিত। এর ফলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি ও অভিযোজনের রূপ নেবে।
বার্ষিক পরিকল্পনা ও বাজেট সংযুক্তি: টেকসই ও কার্যকর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ভিত্তি; ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির (টউগঈ) অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো দুর্যোগ ঝুঁকি চিহ্নিত করে একটি বার্ষিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (অহহঁধষ জরংশ-ওহভড়ৎসবফ অপঃরড়হ চষধহ) তৈরি করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এই পরিকল্পনাগুলো অনেক সময় কেবল সভা রেজুলেশনে সীমাবদ্ধ থেকে যায় এবং ইউনিয়ন পরিষদের মূল বাজেট পরিকল্পনায় প্রতিফলিত হয় না। ফলে দুর্যোগ প্রস্তুতি ও অভিযোজন কার্যক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় না।
পরিকল্পনা যতই বাস্তবসম্মত হোক না কেন, তা যদি বার্ষিক বাজেটে অর্থ বরাদ্দ না পায়, তবে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই বাজেট সংযুক্তি করা খুবই জরুরি। একই সাথে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটাতে হলে বাজেট তৈরিতে বাজেট সংযুক্তি করতেই হবে। বার্ষিক বাজেট প্রক্রিয়ায় দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসকে অন্তর্ভুক্ত করলে স্থানীয় সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া যায়। পরিকল্পনা ও বাজেট একীভূত হলে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়, এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পায়।
জাতীয় নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য: স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯ অনুযায়ী, বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় স্থানীয় জনগণের মতামত গ্রহণ ও বাস্তব সমস্যার প্রতিফলন জরুরি, যার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো দুর্যোগ ঝুঁকি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২ অনুযায়ী টউগঈ-কে স্থানীয় পরিকল্পনার সাথে সমন্বয় করে কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বাজেটে দুর্যোগ পরিকল্পনার প্রতিফলন কীভাবে সম্ভব? টউগঈ প্রস্তুত করা বার্ষিক অ্যাকশন প্ল্যান ইউনিয়ন পরিষদের অউচ (অহহঁধষ উবাবষড়ঢ়সবহঃ চষধহ) ও ত্রৈমাসিক বাজেট চক্রে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পরিকল্পনা তৈরির সময় বাজেট লাইন আইটেম নির্ধারণ করে প্রস্তাব দিতে হবে (যেমন: আশ্রয়কেন্দ্র সংস্কার, রাস্তা মেরামত, দুর্যোগ প্রস্তুতি কর্মশালা, নারীদের জন্য পৃথক নিরাপদ স্থান ইত্যাদি)। ওয়ার্ড ভিত্তিক পরিকল্পনা সভা ও বাজেট শুনানিতে এই পরিকল্পনা তুলে ধরতে হবে।
বাজেট সংযুক্তির সুফল হিসেবে দ্রুত ও পূর্বপ্রস্তুতিতে সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা তৈরি হয়। আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন গ্রহণের প্রস্তুতি বাড়ে, যেমন: এঈঋ বা খউঈঋ-এর তহবিল পেতে বাজেট পরিকল্পনা ও রিপোর্টিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রান্তিক জনগণের চাহিদাভিত্তিক সেবা নিশ্চিত হয়, যেমনঃ খাদ্য, পানি, চিকিৎসা, আশ্রয়। টউগঈ-এর পরিকল্পনাকে ইউনিয়ন পরিষদের বাজেট প্রক্রিয়ার সাথে একীভূত করা মানে শুধু “প্রতিবেদন তৈরি” নয়, বরং এটি বাস্তব কাজের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি এবং অর্থ বরাদ্দের নিশ্চয়তা। এটি দুর্যোগ সহনশীলতা ও জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রকে টেকসই ও জবাবদিহিমূলক করে তোলে।
জলবায়ু সুশাসন ও জলবায়ু অর্থায়নের ইতিবাচক প্রভাব: বাংলাদেশ এখন জলবায়ু সুশাসন (ঈষরসধঃব এড়াবৎহধহপব) ও জলবায়ু অর্থায়ন (ঈষরসধঃব ঋরহধহপব) ব্যবস্থায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম অগ্রগামী। এই দুই প্রক্রিয়া ইউনিয়ন পর্যায়ের জন্য
স্থানীয় বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি: জলবায়ু অভিযোজন ও ঝুঁকি হ্রাসে বরাদ্দকৃত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তহবিল ইউনিয়ন পরিষদে পৌঁছালে, তারা স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারবে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সহায়তা: নারী, জেলে, কৃষক, ভূমিহীন পরিবারসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর (যেমন-হিজড়া, দলিত, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি) অভিযোজন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ ও সহায়তা নিশ্চিত করা যাবে।
স্থানীয় সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: বাজেট ব্যবস্থাপনায় জনগণের অংশগ্রহণ বাড়লে দুর্নীতি হ্রাস পাবে এবং সামাজিক জবাবদিহিতা তৈরি হবে।