খাইরুল ইসলাম, নেত্রকোনা :: আজ জুলাই শহীদ দিবস। এই উপলক্ষ্যে নেত্রকোণা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো ‘জুলাই শহীদ স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিল’। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বক্তারা শহীদদের আত্মত্যাগের গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং বর্তমান প্রজন্মকে তাঁদের আদর্শ অনুসরণের আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. খন্দকার মোহাম্মদ আশরাফুল মুনিম। তিনি বলেন, ‘জুলাইয়ের আন্দোলন কার্যত একক কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, একটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এ ব্যবস্থা বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংস্কারের। রাষ্ট্রকাঠামোকে নতুনকরে ঢেলে সাজানোর আন্দোলন।’ জুলাইয়ের এই চেতনা যেন কোনোভাবেই উজ্জ্বলতা না হারায়, বরং উত্তরোত্তর তার স্প্রিট যেন ঔজ্জ্বল্য হয়ে ওঠে—এমনটাই তিনি তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেন। “জুলাই শহীদরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য লড়াই করেছিলেন। তাঁদের আত্মদানে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের অনুপ্রেরণা রয়েছে।”
বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক ড. আনিছা পারভীন। তিনি বলেন, ‘জুলাই শহীদরা তাঁদের রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছেন—গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো কোনো ব্যক্তিগত সংগ্রাম নয়, বরং তা একটি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। তাঁদের আত্মত্যাগ কেবল অতীতের কোনো স্মৃতি নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য এক গভীর দায়বোধের নাম। তাঁরা আমাদের দেখিয়ে গেছেন কীভাবে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মুখেও সত্য ও মানবিক মূল্যবোধকে ধারণ করতে হয়। এই আত্মদানের ইতিহাসই আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য অনন্ত প্রেরণার উৎস।’ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ।
অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কুরআন থেকে তেলাওয়াত করেন বাংলা বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী মো: আব্দুল বারেক এবং গীতা পাঠ করেন সেকশন অফিসার টুম্পা চক্রবর্তী। আলোচনার এক পর্যায়ে জুলাই শহীদদের জীবন ও ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। যেটার উদ্বোধন করেন ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. খন্দকার মোহাম্মদ আশরাফুল মুনিম। এরপর শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন রাজিব মিয়া (সিএসই বিভাগ), হাফসা ইসলাম মোহ (ইংরেজি বিভাগ) ও রিফাত রেজোয়ান জয় (অর্থনীতি বিভাগ)। তাঁরা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনসহ জুলাই আন্দোলনের নানা স্মৃতি স্মরণ করেন। এবং তারা সবসময়ই স্মরণ করিয়ে দেন যে, যারা একাত্তরকে বাদ দিয়ে চব্বিশকে গ্রহণ করতে চায়, কিংবা যারা একাত্তর এবং চব্বিশকে এক কাতারে দাঁড় করাতে চাই, আমরা তাদের সাথে নেই। চব্বিশ একাত্তরের আন্দোলনেরই স্রোত।
ছাত্র উপদেষ্টা ও বাংলা বিভাগের প্রভাষক সামজীর আহমেদ তাঁর বক্তব্যে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সামাজিক ইতিহাস পর্যালোচনার মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনের চরিত্র বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনকে অনেকেই বিপ্লব বলে অভিহিত করলেও আমি তাকে দেখতে চাই একটি অভ্যুত্থান হিসেবে, যা বিপ্লবের দিকে যেতে পারত। কারণ, বিপ্লবের যেমন থাকে পরিকল্পিত রূপরেখা, তাত্ত্বিক দিকনির্দেশনা এবং সুসংগঠিত নেতৃত্ব, এখানে তার অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। এই অভ্যুত্থান দীর্ঘ দিন চলতে থাকা রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে জমে থাকা যে ক্ষোভ, সেই ক্ষোভের একটি বিস্ফোরণ—তীব্র, তীক্ষ্ণ, কিন্তু সংগঠিত বিপ্লবের কাঠামোবদ্ধ রূপে নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই ছিল এক অন্তঃসারশূন্য ও নীপিড়ক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের ঘনীভূত হতাশার ভাষ্য। এই অভ্যুত্থানের পরবর্তী ধাপে হয়তো কোনো সত্যিকারের বিপ্লব অপেক্ষা করছে—যেখানে রাজনৈতিক চেতনা ও সামাজিক দায়বোধ আরও পরিণত রূপে আত্মপ্রকাশ করবে।’
মঞ্চে বসেছিলেন জুলাই শহীদ আলী হোসেনের ছোট ভাই—চোখে এক গোপন শোকের ছায়া, কণ্ঠে অশ্রুর আর্ত ধ্বনি। তিনি যখন বলতে উঠলেন, তখন শব্দেরা যেন থমকে গেল; প্রতিটি বাক্য যেন ভাই হারানোর গভীর যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন—যেন সময়ের হৃদয়ও কেঁপে উঠল। অন্য পাশে ছিলেন শহীদ জিন্নাতুল ইসলামের মা। তাঁর চেহারায় শত যুদ্ধের ক্লান্তি, চোখে পুত্রশোকের নিঃশব্দ আর্তনাদ। তিনি কথা বলছিলেন, আর তার প্রতিটি শব্দ যেন চূর্ণ হচ্ছিল দীর্ঘদিনের জমে থাকা শোক, অভিমানে। বলছিলেন, কীভাবে তাঁর সন্তান ফেরেনি—কীভাবে একদিন, স্রেফ একটি দিনে, তাঁর জীবনের সমস্ত আলো নিভে গেছে। এবং ঠিক তখন, সামনের সারিতে, মায়ের কোলে বসে থাকা এক ১১ মাসের শিশু—শহীদ জিন্নাতুল ইসলামের কন্যা—চেয়ে ছিল মায়ের চোখের দিকে। শিশুটি জানত না কোন ভাষায় কথা বলে এই বিষণ্ন পৃথিবী, জানত না চোখের জল মানে কী। কিন্তু সে তাকিয়ে ছিল—নির্বাক, বিস্মিত, যেন কোনো আদি বেদনার সাক্ষী হয়ে। মায়ের চোখে যে শূন্যতা, সেই শূন্যতাই শিশুর ভবিষ্যৎ হয়ে দাঁড়ায়—একটি রক্তাক্ত উত্তরাধিকার, এক অদৃশ্য অনাথতা, এক ইতিহাসের বোঝা, যা কাঁধে না-রেখেও বহন করতে হয়। সেই মুহূর্তে অনুষ্ঠানস্থলটি আর কেবল একটি স্মরণসভার জায়গা ছিল না—তা পরিণত হয়েছিল এক নিঃশব্দ প্রতীকমালায়, যেখানে রাষ্ট্রের নিষ্ঠুরতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে ছিল একটি শিশু, তার মা, আর একটি হারিয়ে যাওয়া পুত্রের অন্তহীন আর্তনাদ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেয় এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।
এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও অনুষ্ঠান উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক ছহীহ্ শাফি। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অর্ধশতাধিক মানুষের দোয়া ও মোনাজাতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটি শেষ হয়।